যশোরের প্রায় অর্ধাংশ পানির নিচে !! - SaraBela Online

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Wednesday, July 26, 2017

যশোরের প্রায় অর্ধাংশ পানির নিচে !!



চারদিনের বৃষ্টিতে যশোর জেলার প্রায় অর্ধেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে উজানের পানি কমে গিয়ে নদ-নদীর নাব্য হারানো, অপরিকল্পিত নদী খনন, খননকাজে পুকুর চুরি, টিআরএম চালু না করা, যত্রতত্র মাছের ঘের স্থাপন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের লুটপাট প্রভৃতি কারণে এই অবস্থা হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
যশোর শহরের বিরাট এলাকা এখন পানির নিচে। মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার প্রায় পুরো এলাকাই প্লাবিত হয়েছে। এই তিন উপজেলার ১১৫টি গ্রাম পানিতে তলিয়েছে। এসব এলাকার বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তার ধারে তৈরি করা খুপড়িঘর বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ডুবে গেছে ধান, সবজি, বীজতলাসহ ফসলের ক্ষেত। ভেসে গেছে মাছের ঘেরসহ নানা ধরনের জলাশয়।  প্রশাসনের পক্ষে ইতোমধ্যে একটি উপজেলায় ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
কেশবপুর
কেশবপুরের জলাবদ্ধ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে কেশবপুর শহরের নয়টি ওয়ার্ডসহ উপজেলার প্রায় ৪০টি গ্রাম। ভেসে গেছে দুই হাজার ৩১৮টি মাছের ঘের ও তিন হাজার ২৫০টি পুকুরের মাছ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩২ কোটি টাকা। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার। 
যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের দুই ধারে মধ্যকুল ও হাবাসপোল এলাকার প্রায় ৪০০ পরিবার, আলতাপোলে ৭৫টি ও বাজিতপুরে ৩০টি পরিবার টংঘর বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে। 
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরের কেশবপুর ডিগ্রি কলেজ, পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পাইলট বালিকা বিদ্যালয়, মধুশিক্ষা নিকেতন, মধ্যকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বালিয়াডাঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্রসহ নয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জলাবদ্ধদের জন্য যশোর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দশ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 
গত চার দিনের অতিবৃষ্টি এবং হরিহর, বুড়িভদ্রা ও কপোতাক্ষ নদের উপচেপড়া পানিতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এসব এলাকা। অতিবর্ষণ ও তিনটি নদীর উপচেপড়া পানিতে কেশবপুর পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের প্রায় চার হাজার ৪০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে রাস্তার দুই ধারে টংঘর বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে ৫০৫টি পরিবার। 
অতিবর্ষণে উপজেলা সদর ইউনিয়ন, মঙ্গলকোট, পাঁজিয়া ও বিদ্যানন্দকাটি ইউনিয়নের মুলগ্রাম, পাঁজিয়া পূর্বপাড়া, বাকাবর্শি বেলকাটি গড়ভাঙ্গা ও ব্যসডাঙ্গাসহ প্রায় ৩১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। 
কেশবপুর পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিকী জানান, দীর্ঘদিন ধরে হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদ খনন না করা এবং অপরিকল্পিতভাবে মাছের ঘেরে করার কারণে কয়েক বছর ধরে এখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে। 
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আলমগীর হোসেন জানান, কেশবপুর উপজেলায় দুই হাজার ৩১৮টি মাছের ঘের ও তিন হাজার ২৫০টি পুকুর ভেসে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ৩২ কোটি টাকা। 
কেশবপুর পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়ল জানান, জলাবদ্ধতার ফলে পৌর এলাকার নয়টি ওয়ার্ডের চার হাজার ৪০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। 
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম সাইফুর রহমান বলেন, 'কেশবপুরের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আশ্রয়হীনদের জন্য পৌরএলাকায় দশটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক ইউপি চেয়ারম্যানকে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দশ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এগুলো বণ্টনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
মণিরামপুর
মণিরামপুরের নয়টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভার কামালপুর ও মোহনপুর এলাকাসহ ৪৪টি গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার পবিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৪৬৩টি মাছের ঘের ভেসে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন চাষিরা; ডুবে গেছে ফসলের জমিও। অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন রাস্তাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাছাড়া পানি ঢুকে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে প্রায় অর্ধশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে গত বছরের মতো এবারো মণিরামপুরের শ্যামকুড় ইউনিয়নের বাসিন্দারা বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। 
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) লিংকন বিশ্বাস, সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল কবীর ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইয়ারুল হক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টানা বর্ষণে মণিরামপুরের শ্যামকুড়, খানপুর, দুর্বাডাঙ্গা, কুলটিয়া, চালুয়াহাটি, হরিদাসকাটি, মনোহরপুর, মশ্মিমনগর এবং হরিহরনগর ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া পৌরসভার কামালপুর ও মোহনপুর কারিগরপাড়ার ৩৩৫ পরিবার পানিবন্দি হয়ে রয়েছে।
নাগোরঘোপ স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন এলাকার শতবর্ষী ওয়াজেদ মোড়ল। তিনি বলেন, ‘ঘরের মদ্যি হাঁটু পানি, থাকপো কই? তাই বাড়ি ছাড়ছি।’ একই বক্তব্য আশ্রয় নেওয়া ওই এলাকার রফিকুল ও হাসাডাঙ্গার সোহরাব আলীর। 
শ্যামকুড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনি বলেন, ‘হরিহর নদীর পলি অপসারণ না করায় পানি নদীর দেড় ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। এই পানি সরতে না পেরে তীরবর্তী এলাকায় ঢুকে পড়ছে। ফলে ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের প্রায় তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে ইতিমধ্যে ২০০ পরিবার নাগোরঘোপ, আমিনপুর, চিনাটোলা স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইয়ারুল হক বলেন, ‘স্থানীয় চেয়ারম্যানদের সাথে কথা বলে এই পর্যন্ত মশ্মিমনগরে দুটি কাঁচা ঘর ভেঙে পড়াসহ নয়টি ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে তথ্য পেয়েছি। তাছাড়া প্রায় ৩০০ হেক্টর আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গিয়ে বীজতলাসহ ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে।’ 
ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে দ্রুতই জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে টানা বর্ষণে মুক্তেশ্বরী ও টেকা নদীর পানির ঢলে উপজেলার বিল কেদারিয়াসহ আশপাশের প্রায় ৩৮০ হেক্টর আয়তনের ৪৬৩টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন মাছচাষিরা।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল কবীর বলেন, 'আগামীতে ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। সেকারণে দ্রুত মুক্তেশ্বরী নদীর ১৫ কিলোমিটার এলাকার কচুরিপানা ও পাটা অপসারণসহ খাল দখলমুক্ত না হলে মাছের ঘেরসহ আশপাশের এলাকা প্লাবিত হবে।'
অভয়নগর
টানা বর্ষণে উপজেলার বেশিরভাগ এলাকার বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট, পুকুর মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকার।
অভয়নগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ও নওয়াপাড়া শহরের তিনটি এলাকা টানা বর্ষণে জলাবদ্ধ হয়েছে। ডুবে যওয়া এলাকার মধ্যে রয়েছে, প্রেমবাগ ইউনিয়নের পাঁচটি, সুন্দলী ইউনিয়নের নয়টিসহ পায়রা ইউনিয়নের ৩১টি গ্রাম। 
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নওয়াপাড়া শহর, প্রেমবাগ, সুন্দলী, চলিশিয়া এবং পায়রা ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার ৭৫০ পরিবার। ওই সব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। জলাবদ্ধ এলাকায় কাঁচাবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪০টি। তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডহর মশিয়াহাটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডুমুরতলা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও নওয়াপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় পানিতে ডুবেছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির মধ্যে  আউশ ধান, আমন ধান, সবজি এবং আমন বীজতলা ৩৪০ হেক্টর পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুর রউফ জানান, প্রায় সাড়ে চার হাজার মাছের ঘের (আড়াই হাজার হেক্টর) তলিয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকা। 
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালী বলেন, 'জল কেবল উঠতে শুরু করেছে। যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তাতে গত বছরের মতো ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। সরকার জোয়ারাধার না করে নদী খনন করে অর্থ অপচয় করছে। ফলে জলাবদ্ধতা দূর হচ্ছে না।'
তিনি দ্রুত জল সরানোর ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে বলেন, 'আমরা ত্রাণ চাই না। জল সরানোর ব্যবস্থা করেন।'
জানতে চাইলে অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মনদীপ ঘরাই বলেন, 'উপজেলার প্রায় দুই হাজার ৭৫০ পরিবার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বুধবার থেকে একটি হটলাইন নাম্বার (০১৭৭৮০ ৩৪৫৪৩৪) চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকবে।'
তিনি বলেন, 'ইতিমধ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে নিড অ্যাসেসমেন্ট করেছি। আমডাঙ্গা খাল ও ডুমুরতলা এলাকায় নদীর কচুরিপানা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
উল্লিখিত তিন উপজেলা বাদেও টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে জেলার বহু স্থান। যশোর শহরের দক্ষিণাংশ পুরোটাই এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের একাংশের হাজার হাজার বাড়িতে পানি উঠেছে। এই সব এলাকার বর্ষার পানি মূলত নিষ্কাশিত হয় বিলহরিণা দিয়ে। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে গত কয়েক বছর বিলহরিণা দিয়ে ঠিকমতো পানি বের হচ্ছে না। পানি জমে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন শহরের শঙ্করপুর, বেজপাড়া, বকচরসহ আশপাশের এলাকার হাজারো বাসিন্দা।
শার্শা, বাঘারপাড়া, ঝিকরগাছা, চৌগাছার অনেক গ্রামেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Responsive Ads Here