বাবা ছিলেন একজন বিড়ি শ্রমিক আর মা গৃহিণী। অভাবের সংসারে সাতজন সদস্য। অভাবের কারণে সন্তানদের পড়াশুনার খরচ দেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন বাবা। কোনো রকমে চলে তাদের সংসার। কিন্তু থেমে থাকেনি শফিকুল ইসলাম। তাকে থামাতে পারেনি অভাব। নানান প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে আজ তিনি ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
জেলা সদরের পৌর শহরের পলাশবাড়ি চকিদার পাড়ার আব্দুল খালেকের ছেলে শফিকুল ইসলাম (২৯)। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় জেলায় ৩৬জন বিসিএস ক্যাডার হিসেবে উর্ত্তীণ হয়েছে। এর মধ্যে শফিকুলও একজন।
বাবা আব্দুল খালেক জাগো নিউজকে জানান, পাঁচজন ছেলে সন্তানসহ সাতজনের সংসার তার। শফিকুল ইসলাম চতুর্থ ছেলে। ছোট থেকেই শফিকুলের পড়াশুনার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু অভাবের কারণে ভালো করে পড়াশুনার খরচ দিতে পারিনি। বিভিন্ন সমস্যার কারণে ইংরেজি ও গণিতে খারাপ করছিল শফিকুল। টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়াতে পারিনি ওকে। পাশের গ্রাম বানিয়া পাড়ার লাভলু নামের এক শিক্ষার্থী বিনাবেতনে প্রাইভেট পড়ায় শফিকুলকে। ওর স্কুলের শিক্ষকরাও টাকা-পয়সা দিয়ে যথেষ্ট সহাযোগিতা করেছে। শফিকুল খেয়ে না খেয়ে নিজের চেষ্টা আর মানুষের সহযোগিতায় আজ এতো দূর এসেছে। আমি শফিকুলের সাফল্যে আজ গর্বিত। দোয়া করি ছেলে আমার আরও অনেক বড় হবে।
তিনি জানান, বড় ছেলে হানিফুল ইসলাম (৪০) রং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করছে। দ্বিতীয় ছেলে সামিউল ইসলাম (৩৮) অটোরিকশা চালক। মেঝো ছেলে রফিকুল ইসলাম (৩৫) কাঠমিস্ত্রির কাজ করে। আর সবার ছোট ছেলে মকবুল হোসেন এইচএসসি পড়ছে।
শফিকুলের মা ছবেনা বেগম বলেন, অভাবের সংসারে শুধুামাত্র ১৫শতক বসত ভিটে ছাড়া আমাদের আর কিছুই নেই। চারটি টিনসেড ঘর রয়েছে। খুব কষ্টে এখানেই সবাই মিলে বসবাস করছি। আমার ছেলে তার পরিশ্রমের ফল পেয়েছে। আল্লাহর কাছে শুকুর তিনি অভাবি মায়ের কথা শুনেছেন।
শফিকুল ইসলাম জানান, দারিদ্রতার কারণে সপ্তম শ্রেণিতেই বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল তার পড়াশুনা। পরে শিক্ষকরা স্কুলে বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ করে দিলেও খাতা-কলমসহ অন্যান্য খরচের অভাবে কোনো রকমে চলে পড়ালেখা। ২০০৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে সংসারে আর পড়াশুনার বাড়তি খরচ জোগাতে কাঠমিস্ত্রির জোগালীর হিসেবে দিনে ৩০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন।
এছাড়াও তিনি দিনে ১০টাকা মজুরিতে ব্যানার-ফেস্টুন লেখার কাজও করেছেন। এসএসসি পরীক্ষার দেবার আগে ট্রাকের হেলপারিও করেন তিনি। এভাবেই নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এ প্লাস পেয়ে সবাইকে চমকে দেন।
মানবিক বিভাগ থেকে জেলায় একমাত্র শিক্ষার্থী হিসেবে জিপিএ-৫ পান শফিকুল। কষ্ট করে জীবনে প্রথম সাফল্য পেয়ে পড়াশুনার প্রতি আরও বেশি আগ্রহ বেড়ে যায় তার। শফিকুল পার্বতীপুরের খোলাহাট ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন। উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৭-২০০৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। শিক্ষকসহ বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতায় পড়ালেখা শেষ করা শফিকুল নিজ মেধার জোরে এখন বিসিএস ক্যাডার।
৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে গত ২ মে লালমনিরহাট সরকারি মজিদা খাতুন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদেন।
তিনি আরও বলেন, এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সঙ্গীত শিল্পী কনক চাঁপা তাকে আর্থিক সহায়তা দেন। এরপর ঢাকার ‘মুক্তি আর্ট’ তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত পাশে ছিল। এরপর উপায় অন্তর না পেয়ে তার বিভাগের প্রফেসর আকম জামাল উদ্দিন স্যারের কাছে সব কিছু খুলে বলেন। পরে স্যার তাকে কম্পিউটারের কাজ দেন। এতে করে তিনি প্রতিমাসে দু’হাজার টাকা পেতেন। শফিকুলের পড়াশুনার খরচ যোগাতে যেন একটু আলোর সঞ্চার ঘটলেও কালো মেঘের ছায়া এসে জমাট বাধে। স্যারের একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পর সেই কাজটিও বন্ধ হয়ে যায়। খেয়ে না খেয়ে চলে মাস খানেক। আবারও হতাশাগ্রস্থ শফিকুলের পড়াশুনা বন্ধ হবার উপক্রম হয়ে ওঠে। হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে একদিন বিকেলে রাস্তা হাটতেই দেখা হয় কুড়িগ্রাম সরকারি স্কুলের শিক্ষক আব্দুল মান্নান স্যারের সঙ্গে। সবকিছু খুলে বলার পর তিনি শফিকুলকে প্রতিমাসে দু’হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা শুরু করেন। মাস্টার্স পাশ করার পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি লিফলেট বিতরণ, ডাটা এন্ট্রি কাজ, শো-রুমে থাকার কাজ করেন। এতে তার লক্ষ পূরণে বেঘাত সৃষ্টি হয় পড়ে পড়াশুনা করতে না পারায়। পরে তিনি এসুয়েন্স ও পজিট্রন পাবলিকেশনে কাজ করেন। কম বেতন আর পরিশ্রম বেশি পাশাপাশি পড়াশুনারও ক্ষতি দেখা দেয়। সবকিছু নিয়ে আবার দুশ্চিতা মাঝে মনে পড়ে তার বিভাগের (অবঃ) প্রাপ্ত প্রফেসর কেএএম সাদ উদ্দিন স্যারের কথা।
২০১৫ সালে তার সঙ্গে দেখা করে সব ঘটনা জানালে স্যার তাকে তার সহযোগী হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেন। চাকরিতে যোগ দেবার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। স্যারদের ছাড়াও তিনি এলাকার অনেকেও বিভিন্ন সময় তাকে সহায়তা করেছেন বলে জানিয়ে তিনি সবার কাছে কৃতজ্ঞ প্রকাশ করেন।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, আমার প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে বাবা-মায়ের থাকার ঘরটির মেরামতের কাজ করাবো। বাবা-মায়ের নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালুর স্বপ্ন আছে আমার। তবে সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে আমি অবশ্যই আমার মতো অভাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে চাই। টাকা-পয়সার অভাবে কারও পড়ালেখা যেন থমকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চাই আমি।
এছাড়া, নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার ও বয়স্কদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করার ইচ্ছার কথাও জানান সাফল্য প্রাপ্ত জীবন যুদ্ধে জয়ী বিসিএস ক্যাডার শফিকুল ইসলাম।
No comments:
Post a Comment